–অতিরিক্ত শর্করা থেকে দেহে তেল-চর্বি সংশ্লেষণ
–
ড. সুবোধ চন্দ্র গরাই
|
Professor & Head of the Department of Hepatology, Institute of Post Graduate Medical Education & Research, Kolkata)–এর স্বাস্থ্য নিয়ে দুর্দান্ত ও আলোকপ্রদ বিবৃতি (সংগৃহিত সংশ্লিষ্ট লিঙ্কটি হলঃ https://www.facebook.com/anjan.mandal.921/videos/2132249987030449/ অথবা https://www.youtube.com/watch?v=FPkukpa1brM) থেকে জানা গেল যে যকৃতে চর্বি জমে যাওয়া (“Fatty Lever” Disease) বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও ভীষণ বিপজ্জনক – যা চলতে থাকলে বহুমুত্র (Diabetes) ও হৃদরোগ (Heart Disease)–এর সমুহ সম্ভাবনা সৃষ্টি করে; অথচ ডাক্তারবাবুর অভিমতে এই “ফ্যাটি লিভার” অসুখটির এযাবৎ কোন ঔষধ পাওয়া যায় না – যদিও
তাঁর মতে ঐ ঔষধ অদূর ভবিষ্যতে মিলতে পারে। তিনি জানিয়েছেন যে, এই অসুখটি প্রধানতঃ তথাকথিত নধর দেহের অধিকারী সুখী ব্যক্তিদের এবং এই অসুখটির মূল কারণ মাত্রাতিরিক্ত তেল তথা চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ যা দেহের পক্ষে অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় লিভার (তাছাড়াও ভুঁড়ি ও অন্যান্য বিভিন্ন অঙ্গের কলা সমূহ)-এ ভবিষ্যতে বিপদ সম্ভাবনাকরভাবে জমতে থাকে। তিনি আরও জানিয়েছেন যে, এই অসুখটি থেকে নিস্তার পাওয়ার বর্তমানে একমাত্র উপায় কঠোর পরিশ্রম বা ব্যায়াম এবং সর্বতোভাবে তেল-চর্বি বর্জন।
কিন্তু চিনি তথা শর্করা জাতীয় খাদ্যগুলিও লিভারে এনজাইম বা উৎসেচকের সাহচর্যে শারীরবৃত্তিয় ক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে পর্যায়ক্রমে ফ্যাটি অ্যাসিড্ তথা লিপিড্ বা তেল-চর্বি (বেশি কার্বন সম্বলিত ফ্যাটি অ্যাসিড্ নামক যৌগগুলিকেই সাধারণ তাপমাত্রায় চর্বি বলে গণ্য করা হয়) তৈরী করে। আবার, অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি হল যৌগে অন্তর্ভূক্ত কার্বনগুলির এক বা একাধিক স্থানে যে যে ফ্যাটি অ্যাসিডগুলির দ্বি-বন্ধনী বা Double Bond থাকে সেগুলি – যেমন, সরষের তেল-এর উপাদান সমূহের মধ্যে ১২% সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডগুলির সঙ্গে আবশ্যকীয় (যেহেতু মানবদেহে তৈরী হয় না) Oleic Acid, Linoleic Acid ও Alpha-Linolenic Acid নামক অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি কম-বেশি যথাক্রমে ১২ %, ১৫ % ও ৬ % রয়েছে এবং তাদের যথাক্রমে ১ টি,
২ টি ও ৩ টি –C=C– দ্বি-বন্ধনী রয়েছে জৈব-অ্যাসিডের পরিচায়ক কার্বক্সি মূলকের কার্বন থেকে গণনা করলে যথাক্রমে ৯-১০ নং কার্বনে, ৯-১০ ও ১২-১৩ নং কার্বনে এবং ৯-১০, ১২-১৩ ও ১৫-১৬ নং কার্বনে – এছাড়াও ১৩-১৪ নং কার্বনে অর্থাৎ ১টি দ্বি-বন্ধনযুক্ত ২২-কার্বনের Erucic Acid থাকে ৪২% (তথ্যসূত্র)। বিশেষতঃ সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি আবার অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডগুলির তুলনায় প্রধানতঃ ঐ নধর দেহের অধিকারীদের ক্ষেত্রে অধিকতর ক্ষতিকারক। ডাক্তার ড. চৌধুরীকে অসংখ্য ধন্যবাদ! তবে, এই প্রক্রিয়াটির কথা মাথায় রেখে তিনি অবশ্য চিনি তথা শর্করা জাতীয় খাবারগুলির (একই অসুখের কারণ হিসাবে) অশুভ প্রভাবটিকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন নাই অথবা ওগুলির বিরূদ্ধে সাবধান বানী উচ্চারণের বিষয়টি তাঁর স্মরণে ছিল না।
জল, ঔষধ ও মাদকদ্রব্য বাদ দিলে মানুষ যে সকল খাদ্য গ্রহণ করে তা মূলতঃ দুই শ্রেণীরঃ (ক) প্রাথমিক খাদ্য (Primary Metabolites) – যথা – (১) শর্করা (Carbohydrates), ২) স্নেহ (Fats, Lipids or Fatty Acids ) ও (৩) আমিষ (Proteins) জাতীয় খাদ্যসমূহ এবং (খ) গৌণ তথা আনুষঙ্গিক খাদ্য (Secondary Metabolites) সমূহ। প্রথম শ্রেণীর খাদ্যগুলির অন্তর্গত শর্করা ও স্নেহ জাতীয় খাবারগুলি প্রধানতঃ শরীরাভ্যন্তরস্থ যন্ত্রাদি সচল রাখার ও জৈবরাসায়নিক ক্রিয়াকলাপ এবং স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্যই হৌক আর জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনেই হৌক শক্তি উৎপাদনে দরকার (যদিও প্রোটিন জাতীয় খাদ্য থেকেও আপৎকালীন পরিস্থিতিতে শক্তি উৎপাদিত হতে পারে)। আর (মূলতঃ অ্যামাইনো অ্যাসিডগুলির সমাহার) পলিপেপটাইড্(Polypeptide) বা প্রোটিন তথা আমিষ জাতীয় খাদ্যসমূহ প্রধানতঃ ক্ষয় পূরণ, বৃদ্ধি সাধন ও পরিপাক সহ বিবিধ শারীরবৃত্তিয় ক্রিয়া (Metabolic Processes)-এর জন্য আবশ্যকীয় উৎসেচক তথা জারক রস (Enzyme) সরবরাহের জন্য প্রয়োজন। দ্বিতীয় শ্রেণীর (যার মধ্যে বিভিন্ন ধাতু, অন্যান্য খনিজ পদার্থ ও ভিটামিনগুলিকেও অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে) খাদ্য সমূহের গুরুত্বও অপরিসীম (বিশেষতঃ বয়স্কদের জন্য) – কারণ সুস্বাস্থের জন্য অর্থাৎ শরীর সুস্থ রাখতে তথা বিবিধ রোগ প্রতিরোধ করতে আনুষঙ্গিক খাদ্য (Secondary Metabolites)-গুলির অগণিত ভূমিকা রয়েছে। দেহাভ্যন্তরস্থ কিছু জৈবরাসায়নিক পদার্থ (যেমন, Dopamine, Serotonin, AcetylCholine, GABA অর্থাৎ Gamma-AminoButyric Acid, Oxytocin, Somatostatin ইত্যাদি Neurotransmitters এবং Hexanal, Decanal, Isovaleric Acid, 6-Methyl-3-Hepten-2-One ইত্যাদি Human Kairomones প্রভৃতি) আবার স্নায়ু-মাধ্যমে সংকেত তথা সংবাদ আদান-প্রদানের (Neurotransmitters বা Semiochemicals) জন্যও ভূমিকা পালন করে এবং এগুলিও বিবিধ খাদ্য থেকে পাওয়া যায় (যেমন, কলা থেকে Norepinephrine, Serotonin, Dopamine) বা এনজাইমের সহযোগিতায় দেহে তৈরী (যেমন, অগ্রজ প্রোটীন Proopiomelanocortin, POMC থেকে সম্মুখ পিটুইটারী গ্রন্থীতে প্রধানতঃ সংশ্লেষণ ও সঞ্চিত হয় Beta-Endorphin-গুলি) হয়। শর্করা জাতীয় জৈব
যৌগগুলি হলঃ সেলুলোজ্, শ্বেতসার বা স্টার্চ এবং ইক্ষু-শর্করা সহ ৩-কার্বন বিশিষ্ট সরলতম গ্লিসারেলডিহাইড্ (Glyceraldehyde) থেকে আরম্ভ করে অসংখ্য প্রকারের অধিকতর বেশি কার্বন যুক্ত সরল ও জটিল রাসায়নিক গঠন সমন্বিত বিভিন্ন ধরণের চিনি – এদের মধ্যে সেলুলোজ্ মনুষ্যেতর বেশ কিছু জীব হজম করতে পারলেও আমাদের হজমের অনুপযোগী হওয়া সত্ত্বেও ক্ষতিকর নয়।
এক্ষণে, বর্তমান প্রবন্ধটির মূল প্রসঙ্গে অর্থাৎ, কিভাবে শর্করা তথা চিনি থেকে তেল বা চর্বি শরীরে উৎপন্ন হয় সেই প্রসঙ্গেই আসা যাক। আসলে আমরা শর্করা প্রধান যে সকল খাদ্য (যেমন, ভাত, রুটি, আলু ইত্যাদি) গ্রহণ করি তাদের প্রায় সবটাই স্টার্চ নামক একপ্রকার জটিল শর্করা এবং ঐরূপ জটিল শর্করা জাতীয় খাদ্য মুখে চিবানোর সময় মুখের লালার অন্যতম উপাদান একপ্রকার উৎসেচকের প্রভাবে জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়ায় (Hydrolysis by Salivary
Amylases) ঐ স্টার্চের অনেকটাই সরল চিনিতে তথা প্রথমে মল্টোজ (Maltose, Disaccharide) এবং পরবর্তীকালে পরিপাক প্রণালীতে বাকী প্রায় সবটা জটিল শর্করাই গ্লুকোজ (Glucose), ফ্রুক্টোজ ইত্যাদি অধিকতর সরল চিনি জাতীয় যৌগ (Monosaccharide)-এ পরিণত হয়। কিন্তু আমাদের শরীরে অধিক গ্লুকোজ জমা করে রাখার ব্যবস্থা নাই – তাৎক্ষণিক শক্তির প্রয়োজনে ওজন ও স্বাস্থ্যের সাপেক্ষে মূলতঃ আমাদের যকৃত (Liver) এবং পেশী (Muscle) যথাক্রমে ৭৫-১০০ গ্রাম এবং ২৫০-৪০০ গ্রাম সামান্য জটিল গ্লাইকোজেন (Glycogen) নামক শর্করায় (অন্য উৎসেচক বা Enzyme, Glycogen synthase তথা UDP-Glucose-Glycogen Glucosyltransferase–এর সহযোগিতায়) রূপান্তরিত করে জমিয়ে রাখতে পারে – পরবর্তীকালে আবার শক্তির প্রয়োজনে ঐ গ্লাইকোজেন ভিন্ন উৎসেচক বা এনজাইম (Glucokinase বা Hexokinase)-এর সহযোগিতায় আমাদের লিভার ও পেশীকোষ আবার গ্লুকোজে পরিণত করতে পারে। সুতরাং, অতিরিক্ত গ্লুকোজকে প্রধাণতঃ লিভার রূপান্তরিত করে তেল বা চর্বিতে যার সাধারণ জৈবরাসায়নিক নাম ফ্যাটি অ্যাসিড্ (Fatty Acid, যেমন, ১৬ কার্বনের Palmitic Acid, ১৮ কার্বনের Stearic Acid ইত্যাদি সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড্)। ঐ ফ্যাটি অ্যাসিডগুলি প্রধানতঃ ভুঁড়ি তথা অ্যাডিপোজ্ (Adipose) নামক কলায় গ্লিসারিন বা গ্লিসারল (Glycerol) নামক অ্যালকোহলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ট্রাইগ্লিসারাইড্ (Triglyceride) নামক জৈব যৌগ গঠন করে জমা হতে থাকে – যদি প্রয়োজন আদৌ হয় তবে তা থেকে আবার যেভাবে (অর্থাৎ Beta Oxidation নামক প্রক্রিয়ায়) ভুক্ত তেল থেকে তৈরী হয় সেভাবেই শক্তি-ধারক রাসায়নিক যৌগ এ. টি. পি (ATP, Adenosine
Triphosphate) তৈরী হতে পারে।
গ্লুকোজ থেকে তেল (মূলতঃ যকৃত বা লিভারের হেপাটোসাইট অর্থাৎ Hepatocyte নামক বিশেষ কোষে) বেশ কয়েকটি পর্যায়ে রূপান্তরিত হয় এবং প্রতিটি পর্যায় আবার কয়েকটি ধাপে বিভক্ত – পদ্ধতিটি (অনুরূপ আলোচনা পাওয়া যাবে এরূপ একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত উৎস হলঃ https://www.slideshare.net/drpriyankaclre/carbohydrate-metabolism-31202554?fbclid=IwAR3cbm15wGWZiUtjj3RPJHPc3d7xNkYW0sOELgvrors_4NZ7ARUrw8lQKII এবং Youtube–এও অনুরূপ আলোচনা সমন্বিত বহু ভিডিও পাওয়া যাবে) পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলিতে
অল্প-বিস্তর বিবৃত করা হল।
গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) প্রক্রিয়ার ধাপগুলি
প্রথম পর্যায়ে গ্লাইকোলাইসিস (Glycolysis) নামক প্রক্রিয়া এবং এটি মোট ১০ টি ধাপে সংঘটিত হয় কোষের সাইটোসোল অঞ্চলে – ১ অনু গ্লুকোজ থেকে শুরু হলে প্রক্রিয়া শেষে উৎপন্ন হয় ২ অনু ৩-কার্বনের পাইরুভেট তথা পাইরুভিক অ্যাসিড (অর্থাৎ, AcetylFormic Acid)। সঙ্গের চিত্রটিতে প্রক্রিয়াটি দেওয়া হল (লিঙ্কটি হলঃ http://www2.csudh.edu/nsturm/CHE452/01_Glycolysis.htm)। ধাপগুলি [সংশ্লিষ্ট এনজাইমের নাম তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে] হলঃ ১ অনু গ্লুকোজ (Glucose) [হেক্সোকাইনেজ]→ ১ খানা এ. টি. পি. খরচ করে ১ অনু গ্লুকোজ-৬-ফসফেট (Glucose-6-Phosphate) [ফসফোগ্লুকোজ আইসোমারেজ]→ ১ অনু ফ্রুক্টোজ-৬-ফসফেট (Fructose-6-Phosphate) [ফসফোফ্রুক্টোকাইনেজ]→ ১ খানা এ. টি. পি. খরচ করে ১ অনু ফ্রুক্টোজ-১,৬-বিশ্ফসফেট (Fructose-1,6-Bisphosphate) [অল্ডোলেজ্]→ এরপর ২টি শাখায় → (১) ১ অনু গ্লিসারেল্ডিহাইড-৩-ফসফেট (Glyceraldehyde-3-Phosphate) এবং (২) ১ অনু ডাইহাইড্রোক্সিঅ্যাসিটোন ফসফেট্ (DihydroxyAcetone Phosphate) [ট্রাইয়োজফসফেট আইসোমারেজ্]→ গ্লিসারেল্ডিহাইড-৩-ফসফেট (Glyceraldehyde-3-Phosphate) (অর্থাৎ, মোট ২ অনু) [গ্লিসারেল্ডিহাইড-৩-ফসফেট ডিহাইড্রোজেনেজ্]→ (এই ধাপের প্রয়োজনে ২ টি অজৈব ফসফেট আয়ন ও ২ টি NAD+ আয়ন গ্রহণ করে এবং বিক্রিয়া শেষে ২ অনু NADPH
ও ২ টি আয়নিত হাইড্রোজেন H+ উপজাত হিসাবে লব্ধ হয়) ২ অনু ১,৩-বিশফসফোগ্লিসারেট্ (1,3-BisphosphoGlycerate) [ফসফোগ্লিসারেট কাইনেজ্] → ২ অনু ৩-ফসফোগ্লিসারেট (3-PhosphoGlycerate) এবং ২ খানা এ. টি. পি. জমা করে [ফসফোগ্লিসারোমিউটেজ্]→ ২ অনু ২-ফসফোগ্লিসারেট (2-PhosphoGlycerate) [এনোলেজ্]→ ২ অনু ফসফোএনোলপাইরুভেট (PhosphoenolPyruvate) [পাইরুভেট কাইনেজ্]→ ২ অনু পাইরুভেট্ বা পাইরুভিক অ্যাসিড্ (Pyruvate বা Pyruvic Acid অর্থাৎ সেই AcetylFormic Acid) এবং আরও ২ খানা এ. টি. পি. জমা করে — অর্থাৎ, বাড়তি লাভ, শক্তি অনু হিসাবে নীট ২ খানা এ. টি. পি. (ATP, Adenosine Triphosphate) এই পর্যায়ে পাওয়া যায়।
সাধারণ মানুষের উপকারার্থে এই প্রচেষ্টাটিকে আরও সমৃদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য গুণীজনের মন্তব্য ও পরামর্শ সমাদরে গৃহিত হবে।